রুটির ঝুড়িতে মনুষ্যত্ব


ইসরাত জাহান (আশা) প্রকাশের সময় : ১২/০৬/২০২৪, ৩:৪৫ PM
রুটির ঝুড়িতে মনুষ্যত্ব

ঘুম থেকে উঠে দেখি চারদিক গুমোট অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে! মনে হচ্ছে অন্ধকারে চারপাশের সবকিছু একসাথে মিলেমিশে একাকার। আজ সারাদিন তেমন কিছুই পেটে পড়েনি! ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই যেন ক্ষুধার তীব্রতা আরো বেশি টের পাচ্ছি।

কে জানে, হাতে যা পয়সা কড়ি আছে তা দিয়ে একটা পাউরুটি আর এক কাপ চা খেয়ে এই ক্ষুধাকে দমন করা যাবে কি না!!!

চোখ মুখে পানি ছিটিয়ে ঘরে ফিরে এক গ্লাস পানি খেয়ে পাঁচ টাকার কয়েন দু’টো পকেটে ভরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলাম। বাড়ির বড় ফটকখানা পার হয়ে প্রধান সড়কে আসার পর রাস্তায় হঠাৎ দু-একজন মানুষের দেখা পেলাম।

দোকানগুলোতে জ্বলা মোমের দোদুল্যমান শিখা হতে আলো ভেসে আসছে। সেই মৃদু আলোতে বিপরীতমুখী কয়েকজনের সাথে খুব অল্প সময়ের জন্য চোখাচোখিও হলো। কেউ কাউকে চিনি না। একে অপরের পাশ কেটে দূরত্বের পাল্লা বৃদ্ধি করে আমরা যে যার গন্তব্যের দিকে ছুটে চললাম।

দু-চার পা সামনে এগুতেই দূর থেকে তীব্র বেগে ছুটে আসা একটা আলো দৃশ্যমান হলো। বড় কোন গাড়ি হবে, এদিক বরাবর তেড়ে আসছে। গাড়িটা কাছে আসতেই আমার জীর্ণশীর্ণ চেহারা আর পরিধেয় ময়লা বস্ত্রটি পরিস্কার ফুটে উঠল। অল্প আলোতে এতক্ষন বিষয়টা তেমন বোধগম্য না হলেও ঠিক ওই মুহুর্তে সবটা স্বচ্ছ তরলের ন্যায় স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো।

আমি দ্রুত পায়ে নুরু চাচার দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাইরের একটা বেঞ্চিতে বসে চাচাকে বললাম- ‘চাচা, একটা কড়া চা দিয়ো তো বেশি করে আদা আর লেবু দিয়ে। সাথে পাঁচ টাকার একটা বন রুটিও দিয়ো।’

চাচা চা বানাতে বানাতে কোথাথেকে বেঞ্চির সামনে এসে মুখ ফিরিয়ে বসে পড়ল ‘টুকু’!
বললাম, ‘কিরে, কি অবস্থা তোর?’
‘টুকু’ একটু চেবানোর ভান করে সেই আগের মতোই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো!

চাচা চা বানিয়ে দিয়ে গেলেন।

আমি চা খাচ্ছি আর ‘টুকু’ চোখ গুলো বড় বড় করে মনোযোগ সহকারে আমাকে দেখছে।

এবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? চা খাবি?
এতো গরম চা তোর সইবে?’

ও (টুকু) এবার আমার আরেকটু কাছে এসে বসল।

‘আশ্চর্য! তুই আবার চা খাওয়া ধরলি কবে থেকে?
কুকুররা আবার চা ও খেতে পারে? জানতাম না তো!’- বলে তাচ্ছিল্যের সুরে একটু হাসলাম।

চা শেষ করে কাপ টা চাচার হাতে দিয়ে একটা বন রুটি নিয়ে টাকা মিটিয়ে আবার রাস্তা ধরে ফেরত আসতে শুরু করলাম৷ ভেবেছিলাম টুকুও সাথে আসবে। ও (টুকু) যাতে সাথে আসে সেই ফন্দি আঁটিয়ে রুটি হাতে আমি ফিরতি পথে হাটা ধরেছিলাম। কিন্তু ওতো (টুকু) ওখানেই বসে রইলো।

এতোক্ষণে দোকান-পাট সব বন্ধ হয়ে গেছে, এখন আর সড়কে তেমন আলো নেই। আর ১০ মিনিটের মতো রাস্তা তাই দ্রুত পায়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ পেছনে কার যেন পা ফেলার শব্দ আমার কানে ভেসে এলো। পেছনে কেউ একজন আছে ! ভয়ে গা একটু গুলিয়ে উঠল।
পরক্ষণেই আরেকটু সাবধান হয়ে আওয়াজের দিকে ভালোভাবে মনোযোগ দিলাম। চার পা ফেলার শব্দ বুঝতে আর বেশি দেরি হলো না। তার মানে আমার হাতে থাকা রুটির লোভে কেউ আমার পিছু নিয়েছে। তবে কি টুকু???

অন্ধকারেই পেছন ফিরে বললাম, ‘কিরে, আবার পিছু নিয়েছিস, বেহায়া? কি চাই, তোর? আমার কাছে কি তোকে দেবার মতো কিছু আছে? আর এমন অন্ধকারে এভাবে কেউ পিছু আসে? কোন সাড়া নেই – শব্দ নেই! ভয় করে না বুঝি?

টুকু একবার আস্তে ভেউ করে উঠল!
মনে হয় নিশ্চিত করল, ‘আমি টুকু।’
বড্ড হাসি পেল, আমার ।

ওর কোন নাম নেই! পথে ঘাটেই থাকে, দেখতে খুব মায়াবি!
খুব শান্ত তবে ভোজনরসিক!
তাই আমিই ওকে আদর করে নাম দিয়েছিলাম ‘টুকু’। আমি এ নাম ধরেই ওকে (টুকু) ডাকি।

আজ ওকে (টুকু) বেশ ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছিল।
‘রুটি খাবি?’ বলে, আমার হাতে থাকা রুটিটাকে দু’ভাগ করে এক ভাগ নিজে খেয়ে বাকি আধ ভাগ ছোট ছোট টুকরো করে পাশে ফেলতে শুরু করলাম। ওর (টুকু) ঘ্রাণশক্তি অনেক প্রখর তাই তৎক্ষনাৎ রুটির গন্ধ পেয়ে ও (টুকু) পেছন থেকে সামনে দৌড়ে এসে আমার পাশে হাঁটতে শুরু করল। এভাবেই খানেক দূর অবধি আমরা একসাথে হেঁটে চললাম।

অন্ধকারে রুটির গন্ধ শুকে টুকরোগুলো ও (টুকু) সব খেয়ে নিয়েছে।
রুটির টুকরো শেষ হয়ে যাওয়াতে টুকুকে বললাম, ‘আমার কাছে আর রুটি নেই, রে। আবার আরেকদিন তোকে খাওয়াবো, কেমন?’
আর ওমনি টুকু থেমে গেল।
বললাম, ‘কি হলো?’
ও (টুকু) একবার ভেঁউ একটা আওয়াজ করে আবার উলটো পথে চাচার দোকানের দিকে ফিরে যেতে শুরু করল।
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘বাহ! তোর পিছু ধরা শেষ?? রাক্ষস কোথাকার!
খাবার ছাড়া কি আর কিছু বুঝিস না??
যা! আরেকবার তোকে সামনে পেলে হয়, আমার রুটির ভাগ আমি আর তোকে দিব না।’

ও (টুকু) চলে যাওয়ার পর মন খানিকটা বিষন্ন হলো। এইটুকু রুটিতে হয়তো ওর পেট ভরেনি তাই আরো খানিকটা রুটির সন্ধানে ও আবার দোকানের দিকে ফিরে গিয়েছে। আবার হয়তো দোকানে বসা অন্য কারো দিকে ফিরে সবিনয়ে অনুরোধ জানাবে রুটির জন্য! কেউ ওর (টুকু) চাহনিতে লুকিয়ে থাকা অনুরোধের ভাষা বুঝবে আবার কেউ ওর (টুকু) দিকে ফিরেও চাইবে না।
ক্ষুধার জ্বালা কি আর সবার বোধগম্য হয়?
না, স্রষ্টা আসলে সবাইকে এই বোধ দেননি।

আচ্ছা, ওর (টুকু) তো ঘ্রাণশক্তি খুব প্রখর! তবু ওর (টুকু) কেন মানুষ চিনতে ভুল হয়?
ও (টুকু) কেন বোঝে না যে এই মানুষটা ওর ক্ষতি করতে পারে?ভালো, মন্দ মানুষের কি তবে আলাদা কোন ঘ্রাণ/গন্ধ নেই? থাকলে ওর (টুকু) জন্য খুব সুবিধা হতো!

প্রায় প্রায় রাস্তায় পড়ে থাকা ইট পাটকেল ছুঁড়ে লোকে ওকে (টুকু) ভয় দেখায়, তাড়িয়ে দেয়! মাঝে মাঝে ওর শরীরে আঘাত লাগে, গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
দুদিন না পেরুতেই দেখি ওর শরীরের নানান স্থানে নতুন আঘাতের চিহ্ন! খুব সহজ সাবলীলভাবে ও (টুকু) অন্যের পিছু নেয় শুধুমাত্র সামান্য একটু খাবারের আশায়।
আর বরাবরই শুধুমাত্র এই কারণে ওকে (টুকু) মানুষের নানা নির্মম আচরণের স্বীকার হতে হয়।

খাবার এবং পানির জন্য ওর(টুকু) মতো অবোলা প্রানিগুলো কতটা পরনির্ভরশীল, ভাবা যায়?আমার এখন বড্ড মায়া হয়, ওর (টুকু) জন্য।

লেখক: ইসরাত জাহান (আশা)
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়